Sunday, May 24, 2015

দুই মাসে তিন পার্বণ (তৃতীয় পার্বণ)

প্রতিশোধ

এস-ও-এস কথাটার মানে আমরা কম বেশী সবাই জানি। সেভ আওয়ার সৌলস্ - রবিঠাকুরের নাম ব্যবহার করে একটা বাংলা রুপান্তর ও চালিয়ে দেওয়া যায় - নিস্তারো মোর সত্ত্বা। অতএব বাংলার যে অনুষ্ঠানের নামের মধ্যেই এস-ও-এস আছে, তা যে আমাদের দুই মাসে তিন পার্বণের শেষ ও সেরা পার্বণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জামাইSOSঠী – বাংলার তাবড় শ্বশ্রুপিতারা যেদিন মুখে হাসি রেখেও মনে মনে আর্তনাদ করে ওঠেন, রাবীন্দ্রিক ভাষায় লিখলে যা দাঁড়ায় –

ভরা গ্রীশ্মের দহন কঠোর,
আসিছে জামাতা - অগ্নি জঠর,
বাজারে আগুন, যাহাই কিনুন,
কিছুই তো নহে সস্তা,
লোনের টাকায় জামাতা বিদায়,
নিস্তারো মোর স্বত্বা।
---
দুর্গা আমাদের বাঙ্গালীদের ন্যাশানাল ও ঈন্টারন্যাশানাল জোনে মেইন ঠাকুর হিসেবে সবার ওপরে আছেন। অন্য সব ঠাকুরের থেকে বেশী হাত, সঙ্গে সবথেকে বেশী অন্য ঠাকুর ঘুরে বেড়ান (লক্ষী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, গণেশ, শিব, এমনকি যাকে সংহার করছেন, সেই অসুর ও এক টাইপের ঠাকুর), পাঁচ দিনের পুজো অন্য কারো হয়না, শাড়ী না দিলে ডিভোর্স, ডিস্কাউন্ট না দিলে বয়কট, ছুটি না দিলে রেজিগ্নেশান, বোনাস না দিলে অনশন – এগুলো একসাথে শুধু এই পুজোতেই হয়। তাঁর হাসব্যান্ডও খুব কম পপুলার নন।  প্রাচীন ভুটানের লিঙ্গ ব্যাকুলতা দেখে ট্যুরিস্ট বাঙ্গালী যদিও ফিস ফিস করে অনেক সমালোচনা করেন, “ঈস, ছেলে মেয়ে নিয়ে ‘ওসব’ দেখা, জাস্ট লজ্জাস্কর!” বলে হাহাকার করেন, সেই বাঙ্গালীই আবার প্রতিটি গাছের তলায় মন্দির বানিয়ে ওই একই জিনিসের মাথায় ইয়ের রিপ্রেসেন্টাটিভ হিসেবে দুধ ঢালেন, তখন ‘ওসব’ টাই মূল হয়ে দাঁড়ায়। আদীরস-প্রিয় বঙ্গসন্তানের তাই শিব মন্দির তৈরিতে কোন খামতি নেই। দুই বাংলা আলাদা হওয়ার আগে শীতলা দেবী ছিলেন এপার বাংলার আরেক পপুলার দেবী, কিন্তু বাংলা ভাগের পরে শনি ঠাকুর এপারে বেশ ভালই বসতি গড়েছেন, তাই এখন ওখানে কম্পিটিশান। এদিক ওদিক দু একটা ভৈরবের আস্তানা, বিবি মাতার মন্দির, ওলাইচন্ডীর তলা আর কালীমায়ের ও মনসার আস্তানাও আছে, তাঁরাও মন্দ পপুলার নন। কিন্তু এর মধ্যেও, অলমোস্ট কোন মন্দির ছাড়াই যাঁর সবথেকে বেশী বার পুজো হয় এক বছরে, তাঁর নাম ষষ্ঠী। এনার অনেক গুলো পরব, তার মধ্যে প্রধান – জামাইষষ্ঠী।

একটু মিথোলজি ঘাঁটি – মন্দ লাগবে না। ষষ্ঠিদেবীর ডিপার্টমেন্ট রিপ্রোডাকশান ও চাইল্ড কেয়ার। তার মানে শিবের কৃপা হলে যা যা করা হয়, তার পরের ষ্টেজ টা এনার আন্ডারে। সুন্দরী, নিশ্চয়ই ফিগার কনশাস ও লাইট ওয়েট, নাহলে বেড়ালের পিঠে চেপে ঘোরা যায় না। তবে ছোট দেবতা তো, এক্সিকিউটিভ র্যাঙ্ক এর নয়, তাই ছোট কোম্পানিতে যেমন পান থেকে চুন খস্লেই চাকরি চলে যায়, এনার রাজ্যেও ব্যাপারটা সেরকম। রেগে গেলে বাচ্চাদের চিকেন পক্স করে দেন, সে রোগের ও নাম “মায়ের দয়া”। তাই মা আছেন ভীষন ভাবে। নীল ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী, দুর্গা ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী তো আছে, আর আছে জামাইষষ্ঠী। মহিলার এক সময়ে ছ’টা মাথা ছিলো, এখন একটায় এসে ঠেকেছে, তবে প্রয়োজনে বাকি গুলো বের করতে পারেন। আমাদের স্ত্রীরা পঁয়ত্রিশ পেরোলেই সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীরও মা হয়ে যান, অন্ততঃ হাবে ভাবে, এনার কেস টা তার উল্টো – আগে স্কন্ধের মা বলে পরিচিত ছিলেন, পরে সহচরী – সেই স্কন্ধ, যে কিনা ভেল্লায়ুধা ওরফে শরভ ওরফে মুরুগন ওরফে দেবসেনাপতি ওরফে আমাদের হোমলি কার্ত্তিককুমার – দ্য এল্ডার সন অফ শিভা অ্যান্ড দুর্গা।

একটু কার্ত্তিকের কথা আপনাদের শুনতেই হবে। কার্ত্তিক কিন্তু ওঁদের অ্যাডাপ্টেড চাইল্ড, মানে শিব-দুর্গার। গল্পটা এইরকম - আগুনের দেবতা অগ্নিদেবের উত্তাপ নিয়েই কারবার, কিন্তু একবার মিউট্যান্ট ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট রাক্ষসদের সঙ্গে নতুন টাইপের যুদ্ধ করার জন্য নতুন কাউকে চাই, তাই ওনার বাবা হওয়ার ইচ্ছে হল। এদিক ওদিক মুনি ঋষিদের বউদের নিয়ে ট্রাই করলেন, কিন্তু তারা বলে দিলেন এই হাইপার লোকটাকে জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না, একদম পারভার্ট, পাঞ্জাবি, যা তা করে। এই ফাঁকে স্বাহা নামের এক গেঁয়ো দেবী, যিনি কিনা অনেকদিন ধরে অগ্নিদেবের স্বপ্ন দেখতেন রাত্রে, তাঁর তখন ইচ্ছে হল ট্রাই করে দেখার যদি ট্রায়ালে পাস করতে পারেন – যেমন অনেকের সা-রে-গা-মা-পা তে গান গাওয়ার ইচ্ছে হয়। অডিশনে পাসও করে গেলেন তিনি, আর ফাইন্যাল রাউন্ডে এক্সট্রা প্রিকশান হিসেবে গঙ্গার থেকে একটু জল ধার নিয়ে রাখলেন, কুল্যান্ট হিসেবে – সেই জলের ধারার নাম হল গঙ্গা নদী। শেষ পর্যন্ত ছেলে হল, নাম রাখা হল শরভু – গঙ্গা নদীর ধারে শর গাছের মধ্যে হয়েছিলেন, তাই। সেখানে ছয় কৃত্তিকা স্নান করছিলেন, তাঁদের এই বাচ্চা দেখে শখ হল, বাচ্চাকে দুধ পান করাবেন। শোনা যায়, এক সাথেই ছয় কৃত্তিকার স্তন্যপান করবেন বলে ডারউইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে মিউট্যান্ট এক্সের মতো এক চান্সেই এক্সট্রা পাঁচটা মাথা বের করেছিলেন এই পুত্র সন্তান – তাই সেই কৃত্তিকা থেকেই কার্ত্তিক নামটা চালু।

কিন্তু সে ছেলে ছয় দিনেই বড় হয়ে গেলো, পপুলারিটি সলমান খানের থেকেও বেশী, টানাটানি শুরু হল তাই। স্বাহা কে অগ্নিদেবের বউ বানিয়ে দেওয়া হল বটে কিন্তু আদালত বলে দিলো - পেটে ধরলেই যে মা বলা যাবে তা নয়, উনি সারোগেট মাদারও হতে পারেন। গঙ্গা বললেন আমার দেওয়া জলের সাপ্লাই ছিল বলেই বাচ্চাটা জন্মেছে, তাই ওয়াটার চুক্তির বলে আমিই ছেলের মা। অগ্নিদেব বললেন আমি না থাকলে ইয়েটা কে দিত? কৃত্তিকারাও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন – ওনারা ফস্টার মাদার ব’লে কথা! কি যে হয়, কেউ বলতে পারছে না।

ওদিকে মহিষাসুরকে পটকে দেওয়ার পরে দুর্গার আর বাইরের কাজ বিশেষ থাকে না, তাই বাড়ী নিয়েই পড়ে থাকেন। শিবের সঙ্গে রোমান্সটা বিয়ের আগে ভালই জমেছিল, কিন্তু বিয়ের পরে লোকটার কি যে হল, রোজ কৈলাশে পার্টি ক’রে, নেশার ঘোরে তান্ডব নেচে রাত দুপুরে বাড়ী ফেরে, কখনো আবার ফেরেও না, কনজ্যুগ্যাল লাইফ শিকেয় উঠেছে, কাজের লোক বাড়ী আসে না, এমনকি একটা বাচ্চা কাচ্চাও নেই যে তাকে নিয়ে একটু সময় কাটাবেন। একদিন শিব একটু হাল্কা ছিলেন, দুর্গা আবদার করলেন – আমি জানি না, তুমি যদি নিজে না করতে চাও, ঠিকাচে, কিন্তু আমাকে অ্যাট লিস্ট কোথাও থেকে একটা বাচ্চা এনে দাও, অ্যাড্যাপ্ট করি। ওদিকে কার্ত্তিক কে নিয়ে বাদানুবাদ তখন তুঙ্গে উঠেছে, শিব দেখলেন এই সুযোগ, একদম পাড়ার বড় দাদার মতো সাইটে পৌঁছে বললেন – অনেক হয়েছে কিচাইন, এবারে কেটে পড়ো সবাই, আমিই নিয়ে যাবো এটাকে, আমার আর দুর্গার ছেলে হিসেবেই সবাই জানবে একে। ঠিকাচে, নাম টা নাহয় কার্ত্তিকই থাক। সবাই “ওক্কে, শিবু দা বলছে যখন, তখন অন্যায় চেয়ে নিলাম” বলে কার্ত্তিককে শিবের হাতে হ্যান্ড ওভার করে চলে গেলো, কেউ আর কোন বিশেষ লাফড়া করলো না – আফটার অল শিবুদা বলে কথা। শিব তাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে দুর্গাকে বললেন “এই নাও, তোমার ছেলে, এনে দিলাম, এবারে দেবতা করার দায়িত্ব তোমার”। দুর্গা খুব খুশি, নতুন পাওয়া ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে হাসি মুখে বললেন “ও আর নতুন কথা কি, ও তো সব পুরুষমানুষই ক’রে”।


দিন কেটে যায়, শিব গাঁজা ভাং নিয়ে কৈলাশে পড়ে থাকেন, বাড়িতে বেসিক ট্রেনিং শেষ হলে কেরিয়ারের কথা ভেবে দুর্গা কার্ত্তিককে আর্মিতে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে কার্ত্তিকের খুব উন্নতি হল, প্রমোশান পেয়ে পেয়ে জেনারেল হয়ে গেলেন। দুর্গা খুব খুশি, পাড়ার দেবতাদের আর তাদের বৌদের রামকৃষ্ণ সুইটসের বাক্স পাঠালেন, অনেকেরই তাতে জ্বলে গেলো, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না, আর দুর্গা বুক ফুলিয়ে পাড়ায় ঘুরতে থাকলেন – হাসব্যান্ড নেশাড়ি তো কি, ছেলে টা দ্যাখ, কেমন সোনার টুকরো!

সেরকম থাকলেই ভাল ছিল, কিন্তু তা তো হবার নয়। ময়ূরের পিঠে চেপে যুদ্ধ, অন্যমা কালীর ফেলে রাখা দারু খেয়ে ড্রাইভিং, মাঝে মাঝে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে হরিণ শিকার ইত্যাদি নিয়ে ছিলেন বেশ, যেমন সলমান খান থাকেন, হল কি, একবার ভ্যাকেশানে বাড়ী এসেছেন, দুর্গা তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করে বসলেন – ওরে কাতু, অনেক তো হল, এবারে একটা বিয়ে কর? কার্ত্তিক ফট করে বললেন, “করতে পারি মা, কিন্তু একদম তোমার মতো বউ চাই আমার!”

কি সর্বনেশে কথা! একতা কাপুর তখন নেই, কিন্তু তাও মায়ের বেদম রাগ হয়ে গেল, অনেকবার ফ্রোজেন মোমেন্ট দেখা গেল, ব্রাইটনেস বেড়ে আবার কমে গেল, ঝ্যাং ঝ্যাং করে আওয়াজ হল, স্বর্গের নর্তকীরা আ-আ-আ করে গেয়ে উঠলেন, আর মা দুর্গা, অ্যাজ ইউজুয়্যাল, একখানা অভিশাপ ঝেড়ে দিলেন – বদের ধাড়ী ছেলে, এখনই ঘর ভাঙ্গার প্ল্যান, বাপ টা নেশা করে পড়ে থাকে, ভেবেছিলাম একটা বউ এনে কদিন বাড়ির কাজ হ্যান্ডওভার করে একটু শান্তি তে থাকবো, মাঝে মাঝে বিউটি পার্লার যাব, আর তুই কিনা আমার কম্পিটিটার আনার প্ল্যান করছিস? হবে না? বাপের রক্ত কোথায় যাবে? নে, আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তোর বিয়েই হবে না, বিয়ে করলেই সব বউ বটগাছ হয়ে যাবে – ইউ উইল সাফার ফ্রম ইটারন্যাল সেলিব্যাসি!

ব্যাস, একদম কেলো! ওদিকে প্রজাপতি তো মেয়ে ষষ্ঠীর বিয়ে অলমোস্ট ঠিক করে ফেলেছে কার্ত্তিকের সঙ্গে, ইন্দ্রের সাজেশান মেনে। তিনি বললেন, “বৌদি, এটা কেমন হচ্ছে?” আর ভেল্লিয়াম্মা, – তার কি হবে? ভেল্লি কে জানেন না তো? জানার কথাও না আপনাদের। আমি এই লাইনে আছি তাই জানি। কার্ত্তিক একবার ব্যাঙ্গালোর গেছলো, সম্ভবতঃ আইবিএম এর হয়ে অ্যাক্সেঞ্চ্যুরের সঙ্গে একটা ডিল এর ব্যাপারে, সেখানে লোকাল মেয়ে ভেল্লির সঙ্গে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। কেটে পড়ার চান্স ছিল, কিন্তু কার্ত্তিক একটু হাল্কা নেওয়ায় ভেল্লির বাবা নাম্পি ধরে ফেললেন। নাম্পি তখন মাইক্রোসফটের ইন্ডিয়া হেড, তাই খুব ইনফ্ল্যুইয়েনশিয়াল, চাপের মুখে কার্ত্তিক তাকে বিয়ে করার কথা দিয়ে দিয়েছেন। দুর্গার রাগের খবর কার্ত্তিক তাঁকে ইমেলে জানিয়েছেন, নিম্পি সটান কলকাতায় এসে দুর্গার সঙ্গে দেখা করে বললেন, “ইয়ারে? মুরুগানা ইঙ্গে পো? ওয়েডিঙ্গা মুড়িয়াদে? নো ওয়েডিঙ্গা, নো ফ্যামিলি, এপ্ড়ি পসিবেল ম্যাডাম? ইল্লে ম্যাডাম, রিকোয়েস্টা, প্লিজ কান্সিডারা!”

দুর্গার রাগ কিছুতেই কমে না। এমনকি তামিল ভাষা শুনেও হাসি পাচ্ছে না। তখন নাম্পি আর প্রজাপতি, দুজনে মিলে দুর্গা কে অনেক তেল টেল, বডি স্প্রে, লোশান, কেরালা হারব্যাল ম্যাসেজের ফ্রি পাস আর বিউটি পার্লারের গিফট হ্যাম্পার দেওয়ার পরে একটা কম্প্রোমাইজ হল – ওক্কে, তিনজনে একসাথে থাকতে পারে, কিন্তু নো অফিসিয়াল বিয়ে।

প্রজাপতি বললেন বেয়ান, এটা কি হয়? কিছু তো একটা করুন যাতে অ্যাট লিস্ট বউ বউ বলে মনে হয়? দুর্গা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ঠিকাচে, ষষ্ঠীর ভালো নাম তো দেবসেনা? আর আমার কেতো হল আমাদের আর্মি, মানে দেব সেনা দের সেনাপতি, তাই ওকে দেব-সেনাপতি বলা হয়। হাইফেন টা একটু সরিয়ে দিচ্ছি, ওকে এবার থেকে দেবসেনা-পতি বলে ডাকা হবে, তবে হ্যাঁ, ছেলেটা আমার বনে জঙ্গলে ঘুরে রোগা হয়ে যায়, ওকে বছরে একদিন অন্ততঃ ভাল করে খাওয়াতে হবে। আর আগের যা যা কেস আছে দুজনের, তার এগেন্সটে একটা করে বটগাছ লাগাতে হবে। প্রজাপতি রাজি, না হওয়ার কিছু নেই – স্লিম ফিগারের কার্ত্তিক আর কতো খাবে? উনি প্রমিস করে দিলেন।

অন্য রিলেশান টা তখনো রিসল্ভ হয়নি। ভেল্লি, অর্থাৎ বল্ল নামটা কেমন যেন ঠেকছিল, তাই তার নাম বল্লম করে দিলেন দুর্গা, বললেন “ওই দেখ নাম্পি, আমার ছেলে তোমার মেয়ের নামের জিনিস কে সব সময়ে হাতে ধরে রেখেছে, তাই ওরা সুখেই থাকবে”। শেষে কার্ত্তিক কে আলতো করে বললেন “ওই বল্লম তো সবসময়ে হাতে তুলতে পারবি না, তাই কলকাতায় এলে ওটাকে কেটে ছোট করে পেছনে শরগুচ্ছ লাগিয়ে দিবি, ওটাই তখন তীরের কাজ করবে”।

সল্যুশানে সবাই খুশি। নাম্পি “রোম্বা সন্তোষম ম্যাডাম!” ব’লে ব্যাঙ্গালোর ফিরে গিয়ে জানিয়ে দিলেন, কার্ত্তিকের সঙ্গে দেবসেনা আর ভেল্লি, দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে, আর কার্ত্তিক অন্যভাবে কি করে যেন ভেল্লির মামা হয়, তাই এই বিয়ে সিদ্ধ। আসল কেস টা এদিকের লোকের জানা রইল, কিন্তু দুর্গার ভয়ে কেউ আর মুখ খুল্লো না। কার্ত্তিকের সঙ্গে থেকে থেকে ষষ্ঠীরও ছয় খানা মুখ গজানোর ক্ষমতা হল। তাই এখনো কিছু পুরনো পোর্ট্রেটে ছটা মুখ দেখা যায়। বড় বউ, তাই ওনাকে রিপ্রোডাকশান আর চাইল্ড কেয়ার দেওয়া হল। আর ভেল্লি কে এখন দক্ষিণে বল্লম, আর এখানে তীর হিসেবে দেখানো হয়। কার্ত্তিক এক হাতে ধরে থাকেন তাকে, কিন্তু তাঁর দেবী রুপের পোর্ট্রট আর দেখা যায় না।

এতোটা হ্যাজালে যে চলতো না, এমন নয়। দুটো কারনে হ্যাজালাম। প্রথম কারন, গল্পটা শোনার পর থেকে পেটের মধ্যে গিজ গিজ করছে, বলতে না পারলে ভবম হাজাম হয়ে যাব, তাই। (যাঁরা জানেন না ভবম হাজাম কে, তাঁরা দয়া করে সুখলতা রাও এর লেখা “নিজে পড়” আর “নিজে শেখো” বই দুটি পড়ে নেবেন)। আর দ্বিতীয়টা কারণটা প্রাসঙ্গিক – জামাইষষ্ঠীর পুরো ব্যাপারটা এই মিথোলজি না পড়লে বোঝা যাবে না।

বর্তমানে ফেরৎ আসি। সংস্কৃতিমনা বাঙ্গালী তার চিরশত্রু শীতের সর্দি থেকে ছাড়ান পেতে যে বৈশাখকে বছরের শুরুতে স্বাগত জানিয়েছিল, যে উদ্দীপনায় রবিঠাকুর আর নজরুলের গান গেয়ে রোদ্দুর রায় কে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেই উৎসাহে এখন ক্ষান্তি। বৈশাখ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গেছে এক মাস ধরে, কালবৈশাখী হয় না আর, মাঝে মাঝে নিম্নচাপ হয়, তাতে কিছু বাড়ী ঘর ভাঙ্গে, আর শেষে বাতাসের আর্দ্রতা আরো দুই মাত্রা বেড়ে যায়। দুপুরে শুলে মনে হয় প্রেসার কুকারে শুয়ে আছি, আর মাত্র দুটো সিটি বাকি, তারপরেই হাড় গলে দুধে চোবানো পাঁউরুটির মতো হয়ে যাবে। রাত্রেও শান্তি নেই। এরই মাঝে, দুই মাসে তিন পার্বণের সেরা পার্বণ, জামাইষষ্ঠী।

বাজারে মাছ মাংস সব্জি ফল ফলাদি ইত্যাদি দরাদরি করে কেনাকাটার কাজ টা আগের দিনই মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। দরাদরি করেও যে লাভ হয় কিছু, তা নয় – অগ্নিদেব সদাই ব্যস্ত সেখানে কাজে, যাতেই হাত দেবেন, তাতেই তিনি আছেন। আর জামাইষষ্ঠী ফল ছাড়া হয় না। ফলের মধ্যে প্রথম ফল – আম। বাঙ্গালীর কোষ্ঠকাঠিন্যের ব্যাকুলতা নিয়ে বানানো ছবি পিকু এবছর যেমন ব্যবসা করেছে, আম নিয়ে সৃজিত যদি একটা ছবি করতেন, ধরুন লিকু, সে দারুন ব্যাপার হতো। সারা বছর বাঙ্গালী আমের আশায় থাকে, যখন তখন লিক হতে থাকে সেই আমের আশা আমাষার ফল, আর গ্রীষ্মে তারা সেই আম খায় – প্রথমে কিছু বেহুদা আম, অনামী, টক, হাফ টক, নট সো টক, হাল্কা মিষ্টি, তার থেকে খুব মিষ্টি - হিমসাগর, আর ল্যাংড়া। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে সুন্দর ভাবে লাল রং করা সোনারপুরের মজফফরপুরি লিচু আর ইঞ্জেকশান দেওয়া তরমুজ। আঙ্গুরের আর আপেলের দাম আগুন, কিন্তু কার্ত্তিক বলে কথা, একটু না আনলে চলে? একটু ফুটি হলেও মন্দ হয় না। সঙ্গে একটু খেজুর, আর বেদানা।

জামাইরূপী কার্ত্তিক সকালেই এসে হাজির, সপরিবারে। এবং এসেই খাবেন, আর খেতেই থাকবেন। ওটাই নিয়ম। কাস্টোমারি প্রনামের পরে “এসো বাবা এসো! ওগো শুনছো, অমুকবাবাজি এসে গেছে, ওকে একটু জল দাও” বলে প্রজাপতি শ্বশুরমশাই অন্য ঘরে চলে যান নিজের ভুলের হিসাব করতে করতে, বাই দ্য টাইম স্টেজে হাজির শাশুড়ি মা। ভালোবাসার স্বর্ণভান্ড। জামাই যা চাইছে, উনি তার দ্বিগুন বা তিনগুন দেবেনই – আস্ক ওয়ান, গেট ট্যু মোর ফ্রি! প্রথমেই ফলাহার। আর জামাইও যেন শিবের নয়, অগীর বাচ্চা। যা পাচ্ছে, তাই হাবড়াচ্ছে। এক মুন্ডু নিয়ে ঢুকেছিল, খাবারের প্লেট দেখলেই কৃত্তিকাদের কথা মনে পড়ে যায়, আর ওমনি পাঁচ খানা এক্সট্রা মন্ডু গজিয়ে যায়! “এমা, একি করছেন? এতো কি কেউ খেতে পারে?” বলে ফটাফ্ফট্ প্লেট থেকে পেটে চালান, পাঁচ মিনিটেই মাছিরাও গাল দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। শুধু ফল খেয়ে জল খেতে নেই, তাই কিঞ্চিৎ মিষ্টিরও সুবন্দোবস্ত আছে।

ওদিকে দেবসেনা ওভারইটিং অ্যান্ড এফেক্টস অফ এক্সট্রা ক্যালোরি নিয়ে কার্ত্তিককে একটু ফ্লার্টিং খোঁটা দিয়ে মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে ভিড়ে গেছেন - নিজের পাঁচটা এক্সট্রা মুখ বের করে দুর্গার কেচ্ছা শুরু করে দিয়েছেন, যেন কৈলাশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশান – শ্বশুরবাড়ী কৈলাশে ওনার অত ঠান্ডাতেও কিচেনে ঢুকলে ঘাম হয়, কিন্তু এই প্রেস রিপোর্টিং এর ব্যাপারে ওনার খুব ইন্টারেস্ট, তাই একটুও গরম লাগছে না, ঘাম মুছছেন আর বকেই চলেছেন, নভজ্যোত সিধুর মতো। জামাই বাবাজী এরপর একটু মাঠা মারা লস্যি গিলে শালীদের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট করবেন, শালাকে একটু ডিভাইন জ্ঞান দেবেন, তারপর বিশ্রাম নেবেন, তাই ইলেকট্রিকের বিলের কথা ভুলে গিয়ে এসি চালিয়ে দেওয়া হল। নিজের রুম টার কন্ট্রোল হারিয়ে শালা মনে মনে বলবে, শালা জাম্বু, চার অক্ষরের বোকা, ফোকটে হাবড়াচ্ছে আর জ্ঞান দিচ্ছে ফ্রি তে, এরপর আমার পাজামা পরবে আর শালা আমার বদনাম হবে। এরই ফাঁকে চৈত্র সেলের ডিস্কাউন্টে কেনা শাড়ি, সালোয়ার, পাঞ্জাবি আর টি শার্ট বিতরন হয়ে গিয়েছে, শ্বাশুড়ি তাই আহ্লাদে আটখানা, শালার ও রাগ টা একটু পড়েছে।

লাঞ্চের ডাক পড়ল। সেখানে পঞ্চব্যাঞ্জন সমাহার, কিন্তু জামাইয়ের তাতে একটুও চাপ নেই। পেটে অগ্নিদেব নিয়ে খেতে বসেছেন, সবকিছুই হজম হয়ে যাবে, গ্যারেন্টি আছে – অগ্নিদেব এখনো রেগে আছেন – সেই যে, শিবুদা ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেলো, তার রাগ! এরপর ইলেক্ট্রিকের বিল আরেকটু বাড়িয়ে দুপুরের বৌয়ের সঙ্গে শালার এসি রুম এ দরজায় ছিটকিনি তুলে চামড়া ঘষাঘসি, তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুম আছে, বিকেলে একটু ছাদে হাওয়া খাওয়া আছে। সন্ধ্যায় চা আর সিঙ্গাড়া সহযোগে এ পাড়ার স্পেশ্যাল মাটন রোল আছে। সব হয়ে গেলে রাতের খাবারের ছাঁদা বেঁধে আরেকদফা প্রণাম সেরে কার্ত্তিক আর ষষ্ঠী কৈলাশ অভিমুখে যাত্রা করেন। টা টা করা হয়ে গেলো, শালীরা বলল কার্ত্তিক দা, নেক্সট বারে কিন্তু সিনেমা নিয়ে যেতে হবে, কার্ত্তিক মাথা নাড়াতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। ট্যাক্সি মেন রাস্তায় উঠলে কার্ত্তিক বউকে বলেন “তোমার মা খুব ভাল, কিন্তু তোমার বাপ টা মাইরি চিপ্পুস আছে, শালা আইসক্রিম, আমাদের ওখানে পাহাড়ে দুধ আর চিনি ঢেলে দিয়ে নন্দীকাকু কে দিয়ে একটু নাচ করালেই হয়ে যায়, আর শালা বুড়ো কোয়ালিটির বদলে কি একটা অমল আইসক্রিম না কি খাইয়ে দিল, কাল সিওর ডিসেন্ট্রি”। ষষ্ঠীর ও পাঁচ মুখ বেরিয়ে আসে, মুখঝামটা দিতে। কার্ত্তিক একটা সিগারেট ধরান। ষষ্ঠী অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। একটু পরেই বাড়ী পৌঁছে যাবেন দুজনে, তারপর কালকে অফিস।

ওদিকে প্রজাপতি মশাই রাত্রে রুটি আর কুমড়োর তরকারি খেয়ে শুয়ে শুয়ে স্ত্রীর ঘুমন্ত শরীর হাতড়ান, তারপর আপনা হাথ জগন্নাথ হয়ে ভাবতে থাকেন, পি এফ এর লোন টা এমাসেও শোধ হল না – হে ভগবান, বাঁচাও মোর স্বত্ত্বা, একটু যদি বৃষ্টিও দিতে, কর্তা? একটু পরেই নাক ডাকতে থাকে, দুজনেরই। বাঙ্গালীর থার্ড পার্বণ এভাবেই শেষ হয়।

পুনশ্চঃ – প্রতিশোধের গল্পের শেষ এখানেই নয়। ভেল্লিদের ওখানে কার্ত্তিক এখনো যায়। অফিসের কাজে, যেতেই হয়। গেলেই নাম্পির কথা মনে রেখে কার্ত্তিক কে ওরা ভাত, এরিয়েল, পোরিয়েল, সাম্বার আর রাসম এর সঙ্গে রান্ডিভা কেক আর চেট্টিনাড় চিকেন খাওয়ায় – তাতে একবারেই সাত জামাইষষ্ঠীর পুণ্যফল লুপ্ত হয়। সে প্রতিশোধের কথা অন্য কোনদিন বলবো। 

No comments: